
Science vs Superstition in bengali | বিজ্ঞান ও কুসংস্কার পার্ট ২
আমরা বিজ্ঞান ও কুসংস্কার নিয়ে এর আগের প্রবন্ধটিতে আলোচনা করেছি (পার্ট ১ পড়ুন)। আজ আমরা এই প্রবন্ধটিতে ঠিক সেরকমই আরো কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করব এবং বিজ্ঞানের দৃষ্টি দিয়ে কুসংস্কার গুলিকে বোঝার চেষ্টা করব। পড়তে থাকুন এই প্রবন্ধটি।
● ঘরের চৌকাঠে বসতে নেই কেন ?
মানুষ সাধারণতঃ একটু উঁচু জায়গায় বসতে ভালো বাসে। ঘরের চৌকাঠ ও মেঝের তুলনায় একটু উঁচু বলে সকলেই ওখানে বসতে চায়। কিন্তু ঘরে সব সময়ই প্রয়োজন থাকে। ফলে বার বার ঘরের ভিতর প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু কেই যদি চৌকাঠে বসে থাকে, তবে তাকে ডিঙিয়ে ঘরে ঢোকা ও বের হওয়া অসুবিধা হয়ে পড়ে। তাছাড়া যে বসে থাকে তার গায়ে পাও লেগে যেতে পারে।
এইসব অসুবিধা দূর করার জন্যই এ প্রথার সৃষ্টি হয়। সুতরাং এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এই প্রথার পিছনে রয়েছে যুক্তিপূর্ণ সামাজিক কারণ।
● স্নানের পর ফল খাওয়া উচিত নয় কেন?
প্রতিটি ফলেই থাকে বিভিন্ন ধরণের অ্যাসিড। আমরা যখন স্নান করে আসি স্বভাবতই আমাদের খিদে পায়। আর খিদে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের খালি অন্ত্রের মধ্যে বিভিন্ন কোষ থেকে নির্গত হতে শুরু করে বিভিন্ন রস এবং অ্যাসিড। তখন ফলের অ্যাসিড এবং অস্ত্রের অ্যাসিড ও বিভিন্ন পাচক রসের মধ্যে বিক্রিয়ার ফলে আমাদের অ্যাসিড বা অম্লরোগ হতে পারে। কাজেই দুপুরের খাবার খাওয়ার পরই ফল খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।
● জুতো পায়ে ঘরে ঢুকতে নেই কেন?
জুতোয় লেগে থাকা ময়লা ধুলোবালি ঘরকে অপরিষ্কার করতে পারে এবং তার মাধ্যমে আসা বিভিন্ন রোগের জীবাণু আমাদের দেহে সংক্রামিত হতে পারে ভেবেই এ প্রথার সৃষ্টি হয়েছিল। সংস্কারটি অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত।
● গরম চা খাবার পর জল খেতে নেই কেন?
গরম চা বা গরম খাবার খেলে আমাদের দাঁত গরম হয়ে যায়। পর পরই জল খেলে দাঁতে ঠাণ্ডা লাগে, ফলে দাঁতের এনামেল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দাঁত কমজোরী হয়ে যায় । এছাড়া পান্সে দাঁত বা পায়োরিয়ার রোগীর পক্ষে রোগের আক্রমণ আরো বেশী হয়। তাই যুক্তিটি বিজ্ঞানসম্মত।
● চুল কাটার পর স্নান না করে ঘরে ঢোকা উচিত নয় কেন ?
আমাদের সমাজে, মা, ঠাকুমা, দিদিমারা চুল কাটার পর ঘরে ঢুকতে নিষেধ করেন। আজকের দিনে আমরা হয়তো অনেকে একে কুসংস্কার বলে মনে করি। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, প্রাচীন মানুষেরা কত বিচক্ষণ ছিলেন। কারণ চুল কাটার পর গায়ে মাথায় ছোট ছোট চুলের টুকরো লেগে থাকে। স্নান না করে ঘরে ঢুকলে সেইসব টুকরোগুলো বাতাসে উড়ে খাবারে পড়তে পারে। উক্ত খাবার পেটে গেলে আমাদের শারীরিক ক্ষতি হতে পারে।
● খেতে খেতে উঠে যেতে নেই কি কারণে?
আমাদের সমাজে প্রাচীনকাল থেকে এই প্রথাটির প্রচলন আছে। কেউ খেতে বসলে খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে উঠতে দেওয়া হয় না। শত জরুরী কাজে কেউ ডাকলেও তাকে খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। বিজ্ঞানের দৃষ্টি দিয়ে দেখলে একে সংস্কার বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ খাওয়ার মাঝে কেউ উঠে গেলে তার খাওয়া অসম্পূর্ণ থাকে। ফলে তার শারীরিক ক্ষতি হয়। খাবার পাকস্থলীতে যাওয়া মাত্র বিভিন্ন ধরণের পাচক রস ক্ষরণ শুরু হয় যা খাবারকে হজমে সাহায্য করে। কিন্তু মাঝপথে উঠে গেলে খাদ্যবস্তুর অপেক্ষা রসক্ষরণ বশী হয়ে যায়। এর ফলে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যা শরীরের পক্ষে মোটেই শুভ নয়।
● দোলে আবীর মাখানোর কারণ কি?
দোলের সময় আবীর খেলা একটা ধর্মীয় আচার বলে আমরা জানি। কিন্তু এর পেছনে যে বিজ্ঞানের যুক্তি কাজ করছে তা হলো, দোল উৎসব এমন একটা সময় অনুষ্ঠিত হয় যখন শীতের আবহাওয়া শেষে গরমের আবহাওয়া শুরু হয়। এই সময় আমাদের ত্বকের ওপর বিভিন্ন জীবাণুর সংক্রমণ হয়। আবীর এই সমস্ত জীবাণুর আক্রমণকে প্রতিহত করে। দোলের প্রথা যখন চালু হয় তখন আবীর তৈরী হতো প্রাকৃতিক উপায়ে।
● সন্ধ্যার পর গাছের ফল পাড়া উচিত নয় কেন ?
রাত্রিবেলা গাছ ঘুমিয়ে থাকে। তখন গাছের সালোক-সংশ্লেষ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে। দিনের বেলা এই প্রক্রিয়া চালু থাকে বলে গাছ কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং অক্সিজেন দুটোই ছাড়ে। তাই আমাদের বিশেষ ক্ষতি হয় না। কিন্তু রাত্রে এই প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় গাছতলায় বা তার আশেপাশে অক্সিজেনের প্রচণ্ড ঘাটতি হয় এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে যায়। ফলে আমাদের শরীরের ক্ষতি হয়। তাই রাত্রে গাছের কাছে যাওয়াই উচিত নয়। এছাড়া রাত্রে ফলচুরির ব্যাপারটাও আছে। এই প্রচলিত সংস্কারে সেটাও কিছু বাঁচানো যায় তাই প্রথাটি যুক্তিযুক্ত।
● বিয়ের পরদিন কালরাত্রি পালন করা হয় কেন?
বিয়ের দিন শারীরিক কারণে উপোস থাকতে হয়। এছাড়া মনের ওপর বিরাট চাপ পড়ে। কাজেই পরদিনই যদি বাসররাত্রি হয় তাহলে শরীরের ওপর আরো বাড়তি চাপ পড়তে পারে। শরীর ও মনের শান্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে দেহ অসুস্থ হবার সম্ভাবনা থাকে। মাঝখানে একটা দিন কালরাত্রি পালন করে উভয়ের দেহ ও মনের বিশ্রাম দেওয়া হয়। যাতে পরদিন তাদের নতুন জীবনের যাত্রা শুভ হয়। কাজেই প্রথাটি যুক্তিযুক্ত।
● ভাদ্র মাসে তাল খাওয়া উচিত কেন?
ভাদ্রমাসে প্রত্যেকদিন অল্প পরিমাণ তাল খাবার প্রথা এখনোও গ্রামে গঞ্জে আছে। এর কারণ ভাদ্রমাসে ভ্যাপসা গরম আর প্যাচপ্যাচে বৃষ্টিজনিত আবহাওয়ায় আমাদের হজমশক্তির ব্যাঘাত ঘটে। তালের রস হজমীকারক এবং অগ্নিবৰ্দ্ধক। এ সময় রোজ অল্প করে তাল খেলে হজমশক্তি ঠিক থাকে। তাই বলে বেশী পরিমাণ খাওয়া উচিত নয়।
● রাত্রের উলের পোষাক পরে শোওয়া উচিত নয় কেন?
রাত্রে আমরা যখন ঘুমোই আমাদের বিভিন্ন স্নায়ুতন্ত্রগুলি ঝিমিয়ে যায়। উলের পোষাক শরীরকে গরম করে স্নায়ুতন্ত্রগুলির উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। আমাদের রাত্রের ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে। তাই রাত্রে উলের কোন পোয়াক পরে শোওয়া জীবন বিজ্ঞানের দিক থেকে অনুচিত কাজ।
● এক গালে চড় মারতে নেই কেন?
আজও কেউ গালে চড় মারলে অপর পক্ষকে বলতে শোনা যায় একগালে চড় মারলি কেন, বিয়ে হবে না। এর পেছনে যে যুক্তি কাজ করছে তা হলো চড় মারার সময় উত্তেজনাবশতঃ যদি খুব জোরে লাগে তাহলে আচমকা গাল একপাশে ঘুরে যাবার ফলে আমাদের থাইরয়েড গ্রন্থিতে চোট লাগতে পারে যা বিভিন্ন বিপদের কারণ হতে পারে। তাই প্রথাটি যুক্তিসঙ্গত।
● কেন এক চোখ দেখানো অযাত্রা?
এক চোখ কাউকে দেখানো বা একচোখে হাত দেবার পেছনে অযাত্রা কোন বিজ্ঞানসম্মত কারণ আছে বলে আমাদের জানা নেই। কিন্তু মানসিক দিক থেকে ব্যাপারটি দৃষ্টিকটু লাগতে পারে। কারণ অন্ধ ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ একচোখে হাত দিয়ে রাখলে তাকেও অন্ধ বলে মনে হতে পারে।
● দোলের আগের দিন চাঁচর বা ন্যাড়াপোড়ার রহস্য কি?
পুরাকালের সমাজ সংস্কারকগণ ছিলেন ভীষণ বাস্তববাদী। শুধুমাত্র দোলের আনন্দকে পাকাপাকিভাবে রূপদান করাই নয়। তাঁরা এই ব্যবস্থা চালু করেছিলেন পরিবেশ দূষণ রোধ করতে। এমনিতে কাউকে কিছু পোড়াতে বললে সে নাও পোড়াতে পারে। অনুষ্ঠানের মধ্যে কোন নিয়ম চালু করলে সেই নিয়ম দীর্ঘদিন ধরে চলতে পারে। এখানে পরিবেশ দূষণ রোধ করা বলতে দোলউৎসব পালিত হয় শীতের শেষে। শীতকালে অধিকাংশ গাছেরই পাতা ঝরে যায়। তারপরে আসে ঝড় বৃষ্টি। বৃষ্টির জলে সেই সমস্ত ঝরা পাতা পচে গিয়ে দুর্গন্ধ পোকামাকড় ও রোগজীবাণু সৃষ্টি করে কাজেই প্রথাটির যথেষ্ট গুরুত্ব আছে।
যদি প্রবন্ধটি ভালো লেগে থাকে এবং আপনিও যদি এরকম কোন তথ্য আমাদের কাছে তুলে ধরতে চান তাহলে অবশ্যই কমেন্টে করুন। প্রবন্ধটি আপনার বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করে দিন পরবর্তী বিজ্ঞান ও কুসংস্কার পার্ট ৩ পড়ুন।
0 Comments: